বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নের দুইটি পানির পাম্প এর লুটপাট অব্যাহত রাখতে বরগুনা জেলা যুবলীগ নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এডভোকেট তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী কে অভিনব উপায়ে সহযোগিতা দিচ্ছেন বরগুনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রাইসুল ইসলাম। এমনটাই অভিযোগ করেছেন পাম্পের গ্রাহকগণ।
খোঁজ নিলে জানা যায়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের BWSSP প্রকল্পের আওতায় বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নের গৌরিচন্না ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন এবং মদিনা মসজিদ সংলগ্ন গ্রাউন্ড ওয়াটার সাপ্লাই পাম্প স্থাপন করা হয়। স্থাপনের পর থেকেই পাম দুটি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের মদদ পুষ্ট লোকজনের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। পাম্পের আয়-ব্যয়ের কোন হিসাব-নিকাশ ছাড়াই চেয়ারম্যান তার লোকজনের দ্বারা টাকা লুটপট করছে। পাম্প স্থাপনের সময় গ্রাহকদের নিয়ে একটি পরিচালনা কমিটি করে দিলেও দুই তিন জন মিলে চেয়ারম্যানের দোহাই দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করছে। পাম্পের কোনো সদস্য টাকার হিসাব চাইলে চেয়ারম্যানের ভয় দেখিয়ে তাকে বিভিন্নভাবে অপদস্ত করত। ৫ আগস্ট এর পর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাম্পের সদস্যগণ আয়-ব্যয়ের হিসাব চাইলে মদিনা মসজিদ সংলগ্ন পাম্পের সভাপতি শাহজাদা বিশ্বাস মসজিদে একটি সভা ডেকে হিসাব প্রদান করেন। সেখানে ২০১৯ সাল থেকে ২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট (বাইশ লক্ষ অটাশি হাজার ছয় শত চল্লিশ) ২২৮৮৬৪০ টাকা আয় এবং (বাইশ লক্ষ আটষট্টি হাজার বত্রিশ)৷ ২২৬৮০৩২ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। কোনরূপ ব্যয় ভাউচার ছাড়া দেখানো এই অস্বাভাবিক ব্যয়ের বিষয়ে সদস্যগণ আপত্তি তুললে হিসাব যাচাইয়ের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি যাচাই কমিটি করা হয় এবং যাচাই কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। গ্রাহকদের দাবি তাদের দেখানো আয়ের চেয়ে পাম্পের আয় অনেক বেশি হয়েছে।
এরপরই শুরু হয় পাম্প কমিটির তালবাহানা। পাম্প কমিটির বর্তমান সভাপতি শাহজাদা বিশ্বাস বারবার হিসাব ও রেজুলেশন ঠিক করার কথা বলে মসজিদে বসে জুমার দিন সময় নিতে থাকেন। কমিটি হিসাব দিতে না পারায় চেয়ারম্যান ও তার দোসরদের লুটপাট এর বিষয়টি সামনে আসলে চেয়ারম্যান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীকে নিয়ে ঘটনা স্থলে আসেন বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। নির্বাহী প্রকৌশলী উপস্থিত সদস্যদের সাথে কথা বলে আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। তবে তিনি সেটা না করে চেয়ারম্যান ও তার কর্মীদের লুটপাটের বৈধতা দিতে প্রকল্পের মূল পরিচালনা নীতিমালা গোপন করে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ মনগড়া ভাবে প্রকল্প পরিচালনা ও আয় ব্যয় হিসাব-নিরীক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করেন। নতুন নীতিমালায় সভাপতি হিসেবে চেয়ারম্যান কে নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। অথচ পাম্প স্থাপনের সময় গঠিত পরিচালনা কমিটিতে পাম্পের গ্রাহক সভাপতি করা হয়েছে। পরবর্তীতে ২০২১ সালের কমিটিতে ও গ্রাহকদের মধ্য থেকে সভাপতি নির্ধারণ করা হয়েছে। নীতিমালায় নিরীক্ষা কমিটির আহবায়ক করা হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ সচিব কে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে স্থানীয় ইউপি সদস্যকে যারা দুজনই সভাপতি অধীনস্ত। এছাড়া পার্শ্ববর্তী মসজিদের সাধারণ সম্পাদককেও নিরীক্ষা কমিটির সদস্য করা হয়েছে। উল্লেখ্য মসজিদ কমিটির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শাহজাদা বিশ্বাস পাম্প কমিটির বর্তমান সভাপতি।
পাম্পের গ্রাহকদের দাবি নির্বাহী প্রকৌশলী বুঝে শুনে ঠান্ডা মাথায় এই নীতিমালা তৈরি করে চেয়ারম্যান ও তার অনুসারীদের লুটপাটের বৈধতা দিয়ে লুটপাট অব্যাহত রাখতে চেয়ারম্যানের নির্দেশে এই কাজটি করেছেন। একটি সরকারি প্রকল্পের কোন নীতিমালা থাকবে না এটা হাস্যকর কথাবার্তা। লুটপাটে সহযোগিতা দিতেই নির্বাহী প্রকৌশলী মূল নীতিমালা গোপন করেছেন।
পাম্পের গ্রাহক মোস্তাফিজুর রহমান মিলন বলেন, পাম্পের সাবেক কমিটির সভাপতি আব্দুল বারী, বর্তমান সভাপতি শাহজাদা বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম ছাড়া এখানে আয় ব্যয়ের হিসাব কেউ জানে না। কেউ হিসাব চাইলে চেয়ারম্যানের কথা বলে হুমকি দেন।
পাম্পের আরেক গ্রাহক মোহাম্মদ নুরুল হক মাস্টার বলেন, পাম্পের আয়-ব্যয় এর হিসাব সকল সদস্যদের জানার অধিকার আছে। কেউ হিসাব চাইলে তারা বলে কার কাছে হিসাব দেবো? চলেন চেয়ারম্যানের কাছে যাই। দুই তিনজন ছাড়া পরিচালনা কমিটির লোকজনও কেউ হিসাবের খবর জানে না। পাঁচ বছরে কমিটি গঠন ছাড়া আর কোন রেজুলেশন নেই। হিসাব প্রদানের দিন আমি এই বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুললে পরবর্তীতে তারা পাঁচ বছরের রেজুলেশন একত্রে করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাক্ষর নিয়েছে।
পাম্প গ্রাহকদের সাধারণ সভায় নির্বাচিত নিরীক্ষা কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ জহিরুল হক বলেন, বর্তমান কমিটির সভাপতি শাহজাদা বিশ্বাস সভা করে ২২ লক্ষ ৮৮ হাজার ৬৪০ টাকার একটি হিসাব দাখিল করেছেন। সেই সভায় ৫ সদস্যের একটি নিরীক্ষা কমিটি করা হয়। ১৫ দিনের মধ্যে নিরীক্ষা কমিটির বরাবরে ব্যয় ভাউচার গুলো দাখিল করার কথা ছিল কিন্তু তারা সেটি না করে ভাউচার ও রেজুলেশন ঠিক করার কথা বলে সময় ক্ষেপন করছে। শুনেছি নির্বাহী প্রকৌশলীর মাধ্যমে হিসাবের বৈধতা দিতে একটি মনগড়া কমিটি করে লুটপাটের বৈধতা নিয়েছেন। কোথায় দেশ স্বাধীন হয়েছে? আওয়ামীলীগের দালালরা এখনো অফিসের বড় কর্তা সেজে আওয়ামী দোসরদের লুটপাটের রাস্তা তৈরি করে দিচ্ছেন।
পাপ স্থাপনের সময় মদিনা মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পাম্প পরিচালনা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ শরিফুল ইসলাম ফরিদ বলেন, পাম্প স্থাপনের সময় কথা ছিল পাম্পের ব্যয় বাদে যে টাকা থাকবে তা মসজিদ পাবে এ কথার উপর মসজিদের জমিতে পাম্প স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু পাম্প স্থাপনের পরে কমিটির দুই তিন জন মিলে চেয়ারম্যানের কথায় পাম্প পরিচালনা করছেন। কাউকে হিসাবও দেননি মসজিদে ও টাকা দেননি। আমি এ বিষয়ে আপত্তি তুললে তারা আমাকে এড়িয়ে গেছে। পাঁচ বছর পরে তারা আমার কাছে এসেছিল রেজুলেশনের স্বাক্ষর নিতে আমি স্বাক্ষর করিনি।
সাধারণ সম্পাদক মোঃ শহিদুল ইসলামের সাথে অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলতে একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
পাম্প পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোঃ শাহজাদা বিশ্বাস নিজেকে সহ-সভাপতি দাবি করে বলেন, আমার কাছে আয়-ব্যয়ের সকল হিসাব আছে। জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলীর নীতিমালা অনুযায়ী অডিট করা হয়েছে। তবে অতিরিক্ত টাকা না থাকায় ব্যাংকে লেনদেন করা সম্ভব হয়নি।
গৌরীচন্না ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা অ্যাডভোকেট তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপারে অভিযোগ থাকতেই পারে তবে সেটি সুনির্দিষ্ট হতে হবে। চেয়ারম্যান যে কমিটির সভাপতি সেটির অডিট কমিটির প্রধান ইউনিয়ন পরিষদ সচিব হতে পারে কিনা? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী ভালো বলতে পারবেন। তিনি নীতিমালা তৈরি করেছেন।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বরগনা এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রাইসুল ইসলামের অফিসে বারবার গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। মুঠো ফোনে কল করলে তিনি নিউজ এর বিষয়ে শুনে ফোন কেটে দেন।