ছাত্রলীগ নেতা ও তার ভাইয়ের ত্রাসের রাজত্ব, মুখ খুলেছে ভুক্তভোগী পরিবার

কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা ছাত্র লীগের সাবেক সভাপতি কুর্শা গ্রামের জাফর আলীর ছোট ছেলে ইমরুল হাসান। উপজেলার ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে বেরিয়ে আসছে তার সকল অনিয়ম ও অত্যাচারের কথা। আর তার সহযোগি ছিলেন সহোদর বড় ভাই জহিরুল ইসলাম। মুখ খুলতে শুরু করেছেন পরিবারের সদস্য ও ভুক্তভোগী স্থানীয় লোকজন। জমি দখল, টেন্ডারবাজি, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, লুটপাট, শারীরিক নির্যাতন করাসহ অভিযোগের যেন অন্ত নেই।

জানা যায়, ইমরুল হাসান ছোটবেলা থেকেই বেশ ডানপিঠে ছিলেন। বাবার তেমন অর্থ সম্পদ না থাকলেও স্থানীয় এমপি আফজাল হোসেনের ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগের সভাপতির পদ ভাগিয়ে নেন। এরপর থেকেই অর্থনৈতিক দিক থেকে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে ইমরুল হাসান। পুরো উপজেলায় যেমন ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছেন তার চেয়ে বেশি নিজ গ্রামের মানুষ ও পরিবারের সদস্যদের সাথে ঘটিয়েছে। আধিপত্য বিস্তার করে জোরপূর্বক দখল নিয়েছেন জমি, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, মানুষকে শারীরিকভাবে নির্যাতন।

ইমরুলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আসে তার পরিবার ও এলাকাবাসীর কাছ থেকেও, ইমরুল হাসান ছাত্রলীগের সভাপতির পদ পাওয়ার পরেই সাব-কন্ট্রাক্টে কন্সট্রাকশনের কাজ করা শুরু করেন। টেন্ডারবাজির মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প ক্ষমতার দাপটে নিজের কন্সট্রাকশনে ভাগিয়ে নেন। আর সেইসব প্রকল্প নিম্নমানের ও সস্তা কাঁচামাল দিয়ে বাস্তবায়িত করার মাধ্যমে বাজেট কৃত অর্থ হরিলুট করেন। এমনকি সরকারের দেওয়া গরিব অসহায় মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণেও ব্যবহার করেছেন এইসব সস্তা ও নিম্নমানের কাঁচামাল। দীর্ঘদিন যাবৎ অবৈধ ভাবে নিষিদ্ধ ইট-ভাটা পরিচালনা করে আসছে ইমরুলের পরিবার। তা নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের কাছে এলাকাবাসী অভিযোগ করলেও কোন প্রতিকার পাইনি তাদের দলীয় অধিপত্যের কারনে। ইমরুল হাসান দূর্নীতি ও বিভিন্ন অবৈধ কাজের মাধ্যমে মালিক বনে গেছেন কোটি কোটি টাকার।

তার সঙ্গী ছিলেন তার সহোদর বড় ভাই জহিরুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে নারী কেলেঙ্কারীর ঘটনা। যদিও সুষ্ঠু বিচার না পেয়ে জীবনের নিরাপত্তায় পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে বাস করছেন ভুক্তভোগী পরিবারটি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগী ওই নারীর স্বামী বলেন, ২০১৯ সালে ইমরুলের বড় ভাই জহিরুল ইসলাম আমার স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে বসতঘরে প্রবেশ করে ধর্ষনের চেষ্টা করে। এসময় আমার স্ত্রী’র ডাক চিৎকারে প্রতিবেশী লোকজন বাড়িতে এসে জহিরুলকে হাতেনাতে আটক করে।

পরে ইমরুল তার রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে জোরপূর্বক তাদের কাছ থেকে জহিরকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ভুক্তভোগী ওই নারীর স্বামী প্রতিবাদ করলে ইমরুল হাসান তাকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে রড দিয়ে পিঠিয়ে আহত করে। পরবর্তিতে তার নামে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ডাকাতি মামলা দেয়। এ কারণে জেল কাটতে হয়েছে। গরীব ও অসহায় হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এর বিচার পাইনি। পরবর্তিতে আদালতের আশ্রয় নিলে আমাদেরকে মেরে ফেলার ভয় দেখায়। এরপর থেকে জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে চট্টগ্রামের হালিশহরে বসবাস শুরু করি। এখন পর্যন্ত সেখানেই রয়েছি। ক্ষমতার প্রভাবে সুষ্ঠু বিচার থেকেও বঞ্চিত হয়েছি। তবে আওয়ামী লীগের প্রভাব রাজনৈতিক কাটিয়ে ইমরুল যে মিথ্যা মামলা দিয়েছিল তা সে পরবর্তীতে আদালতে স্বীকার করেছে

প্রশাসনের কাছে এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনগণের দাবি, এখনি ইমরুল হাসানের সকল অবৈধ কাজ বন্ধ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। যেন পরবর্তীতে কেউ এধরণের অবৈধ কাজ করতে সাহস না পায়।

এদিকে ইমরুলের দুই চাচার অভিযোগ, তাদের দুই ভাইয়ের ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত হয় একই ক্যাম্পাসে একটি আলিম মাদ্রাসা, একটি কওমি হাফেজিয়া মাদ্রাসা, মসজিদ, গোরস্থান, কম্পিউটার ল্যাব। সেই মাদ্রাসার জায়গা দলীয় ক্ষমতার দাপটে ইমরুল ও তার পরিবার দখল করে রাখে প্রায় এক যুগ ধরে। ফলে মাদ্রাসার জায়গা সংকলনের জন্য মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ করা যাচ্ছে না। ফলস্বরূপ মাদ্রাসার অর্ধেক শিক্ষার্থীদের আধুনিক ক্লাস রুম ও আবাসিক সেবা প্রদান করতে ব্যর্থ ।

শুধু তাই নয়, ইমরুল মাদ্রাসার কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য কুর্শা গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা আইন উদ্দিন নামক এক ব্যক্তির মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর অভিযোগ দায়ের করে। যেখানে মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, পরিচালক, শিক্ষক সবাই জামাত বিএনপি’র রাজনীতির সাথে জড়িত বলে অভিযোগে বলা হয়। মাদ্রাসায় সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের উত্থান হবে। এবিষয়ে আইন উদ্দিন বলেন, ইমরুলের প্রভাবে আমি দরখাস্তে সাক্ষর করেছি। আমি মাদ্রাসার বিরুদ্ধে দরখাস্ত কিনা জানতাম না। আমার নিজের সন্তানও এই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছি।

খোজ নিয়ে আরও জানা যায়, গত ১৯ জুলাই ইমরুলকে আসামী করে কিশোরগঞ্জের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিস্ফোরক পদার্থ আইনে মামলা করা হয়। ২০২৪ সালের ২ আগস্টেও ইমরুল ও তার বড় ভাই জহিরের বিরুদ্ধে নিকলী থানায় মামলা দায়ের হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পরও এখনও বহাল তবিয়তে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইমরুল। তারা আজও ধরা ছোঁয়ার বাহিরে রয়েছে।

এবিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য ছাত্রলীগ নেতা ইমরুলকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আরেক অভিযুক্ত ইমরুলের বড় ভাই জহিরুল ইসলাম মুঠোফোনে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যে। আমরা এমন কোন কর্মকাণ্ড করিনি।

Recommended For You