হাসিনার সঙ্গে ফোন কল; দ্বায় নিচ্ছে না আ.লীগের কোন নেতা

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোন কলে কথা বলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছিল বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সদ্য সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গির কবির এবং তার ছেলে জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জুবায়ের আদনান অনিক। তাদের এই কর্মকান্ডে অনেকটাই হতবাক-বিস্ময় এবং ক্ষুব্দ বরগুনার আওয়ামী লীগের নেতারা।

জেলার নেতাদের দাবী, সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর অনেকটাই বিধ্বস্ত ও মর্মাহত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা ৭০ বছরের পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে আছেন। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলছে এখনো। পাত্তা নেই এতদিনের প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদেরও। এমনকি শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর নিজ নিজ এলাকা ছাড়েন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ এ দলটির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। জেলার প্রতাপশালী নেতাদেরও খোঁজ মিলছে না। এর ভেতর জেলার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে পুরো জেলার নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলে দিয়েছেন। একের পর এক মামলায় জর্জরিত হচ্ছেন নেতা-কর্মীরা। যেসব নেতা-কর্মী মামলার আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তারাও দল ক্ষমতায় থাকা কালিন কোনঠাসা ছিল, দল থেকে কোন প্রকার সুযোগ সুবিদাতো দুরের কথা, অনেকে পদ-পদবীও হারিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সিনিয়র এক নেতা বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা আওয়ামী লীগের ভেতর গ্রুপিং করে রেখেছেন। ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে দলের সুবিদা নিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। জেলা পরিষদ প্রশাসক থেকে তিনি যে অর্থের প্রভাব এবং দাপট দেখিয়েছেন সেই দ্বায়ভার জেলার অন্য কোন নেতারা নিতে রাজি নন। পলাতক শেখ হাসিনার সঙ্গে যদি কোন নাশকতার পরিকল্পনা করেন তবে সেটা জাহাঙ্গীর কবির এবং তার ছেলে জেলা যুবলীগের নেতা জুবায়ের আদনান অনিকের ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে অন্যকোন নেতারা বা কর্মীরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।’এসময় তিনি আরো বলেন,‘আমরা সাধারন রাজনীতি করেছি। জেলার হাতেগোনা ১০ থেকে ১৫ জন নেতা দলের প্রভাব দেখিয়ে ঠিকাদারী-কমিশন বানিজ্য-নিয়োগ বানিজ্য-ঘাট ইজারাদারসহ সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়ে লুটপাট করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। আমরা দলের কর্মীরা কোন লাভবান হইনি। উল্টো জাহাঙ্গীর কবিরসহ জেলার বেশ কয়েকজন নেতাদের কথার অবাধ্য হলে নির্যাতনের শিকার হয়ে পদ-পদবীও হারাতে হয়েছে। তাই এই ফোন কলের দ্বায়ভার আমরা নিতে রাজি নই। আমরা চাই প্রকৃত ঘটনা তদন্তে করে দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করা হোক।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নেতা বলেন, ‘জেলার অনেক কর্মী আছে যারা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত থেকেছেন। জেলা আয়ামীলীগ পারিবারিক বলয়েরে প্রভাবে কর্মীরা কোনঠাসা ছিল। অনেক কর্মী চিকিৎসার অভাবে অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে রয়েছে, অনেকে মারা গেছে। দলের দুর্দিনে কর্মীদের বঞ্চিত করে রেখেছিল এইসব সুবিদাবাদি নেতারা। আমরা এখন কোন অশান্তি চাইনা।আমরা শান্তি চাই। আমাদের বিশ্বাস আছে, অর্ন্তবর্তিকালিন সকার একটা সুষ্ঠ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। তাতে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে তবে আমরা বিএনপিকে সাধুবাদ জানাবো। আমরা শান্তির পক্ষে, অঅমরা চাই বরগুনাতে শান্তিপুর্ণ রাজনীতি চলমান থাকুক, এখানে একই পরিবারের অনেকে আছে যে, এক ভাই বিএনপি করেন আবার আরেক ভাই আওয়ামী লীগ করেন।’ উপজেলার আরেক নেতা বলেন, এতো দিন বিএনপিসহ অন্যদের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। বরগুনা জেলাটা একটা শান্তির জেলা ছিল। এখানে বিএনপি-আওয়ামী লীগ সবাই সবার মত করে যে যার রাজনীতি করেছেন। তবে জেলার গুটি কয়েক নেতাদের দ্বারা অন্য দল না শুধু, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের এইসব অপকর্মের দোষ আমরা নিতে রাজি নয়। আমাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার কোন কথা হয়নি। জেলার সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির ও তার ছেলে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা জুবায়ের আদনান অনিক কথা বলেছেন। তারা বাপ-বেটা দেখাতে চেয়েছেন যে, জেলা আওয়ামী লীগ তাদের দুই বাপ বেটার নিয়ন্ত্রণে আছে। এই ঘটনার সঙ্গে আমরা কেউ জড়িত না।

বরগুনা জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে একটা চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে দলের কোন সুবিদা পাননি তারা। আত্মীয় করণ থেকে শুরু করে লুটপাটে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই করা ছিল এসব নেতাদের প্রধান দায়িত্ব। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরগুনা সদর উপজেলায় বেশ কয়েকজন নেতার একছত্র আধিপত্য ছিল। যারা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবিরের বিশেষ মদদপুষ্ঠ নেতা ছিলেন। আমতলী উপজেলায় সদ্য সাবেক মেয়র মতিয়ার রহমানের একক রাজত্বে ভয়ে কেউ মুখ খুলতো না। গরুর হাট দখল, লঞ্চ ঘাট-ট্রলার ঘাট ইজারাসহ ঠিকাদারীতে তাদের ছিল একক নিয়ন্ত্রণ। (পাঠকদের জানিয়ে রাখতে চাই এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আমাদের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। আমরা তাদের ক্ষমতারে দাপটে ত্রাসের রাজত্ব প্রকাশ করবো।)

শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোন কলের ঘটনায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতারা ক্ষুব্দ রয়েছেন। অনেকেই দাবী করেছেন, লুটারদের হাত থেকে জেলা আওয়ামী লীগ উদ্ধার করে তরুণদের হাতে নেতৃত্ব আসুক। আর যেন কেউ দলের প্রভাব দেখিয়ে ক্ষমতার দাপটে লুটপাট না করতে পারে সেজন্য আইনের মাধ্যমে তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জোর দাবী জানাই। আমরা চাই এইসব রাঘব বোয়ালদের অর্থের উৎস তদন্ত করে সব বাজেয়াপ্ত করা হোক। বরগুনার আওয়ামী লীগের সাধারন কর্মীরা যাদে মিথ্যা মামলা আর হয়রানী না হয় সেজন্য সবার কাছে জোর মিনতি করেছেন একাধিক নেতা।

উল্লেখ্য, গত ১২ আগস্ট রাতে জাহাঙ্গীর কবির নিজ বাড়িতে বসে শেখ হাসিনার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। এসময় তিনি শেখ হাসিনাকে মনে সাহস রাখার পরামর্শ দেন। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, জাহাঙ্গীর কবির যখন মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন তখন জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তারা শেখ হাসিনার পক্ষে স্লোগান দেন। এর আগে ১০ আগস্ট জাহাঙ্গীর কবিরের নেতৃত্বে বরগুনা শহরে আওয়ামী লীগ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। পরে হাসিনার সঙ্গে ফোনালাপের ঘটনায় বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তার ছেলের বিরুদ্ধে বরিশাল সাইবার ট্রাইবুনালে মামলা হয়েছে। তবে মামলার আবেদনে ৩১ জনকে আসামি করা হলেও ২৯ জনের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য-প্রমাণ না দেওয়ায় তাদের অব্যহতি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক। গত বুধবার বরিশাল সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. গোলাম ফারুক মামলাটি গ্রহণ করে বরগুনা সদর থানার ওসিকে ৯ অক্টোবরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেন। এর আগে মঙ্গলবার বরিশাল সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলাটির আবেদন করেন বরগুনা সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক। আসামিরা হলেন, বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর কবির ও তার ছেলে জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জুবায়ের আদনান অনিক। এর মধ্যে জাহাঙ্গীর কবীর চাঁদাবাজির দুটি মামলায় আগেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। আদালতের বেঞ্চ সহকারী নাজমুল হাসান বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা আছে কি-না সেই বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বরগুনা সদর থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করার পর ১২ অগাস্ট রাত সাড়ে ৮টায় বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর তার বরগুনার বাসায় নেতাদের নিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে তিন মিনিট কথা বলেন। যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ভাইরাল হয়। সেই ভিডিও অন্য আসামিরাও তাদের মোবাইল ফোন দিয়ে ভাইরাল করেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামিরা রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার উদ্দেশে সাধারণ জনগণের মধ্যে ভয়ভীতির সঞ্চার করতে এমন কাজ করেছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন আসামিরা বিভিন্নভাবে জমি দখল ও অপকর্মের জড়িত ছিলেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

Recommended For You