ইটভাটায় পুড়ছে রঙিন শৈশব!

যে বয়সে হাতে বই-খাতা কাঁধে স্কুলব্যাগ থাকার কথা, সে বয়সেই শক্ত হাতে হাল ধরেছে সংসারের। সারাদিন খেটে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রোজগার ১৬০ টাকা। এই টাকা থেকেও আবার ২০/৩০ টাকা যাচ্ছে সর্দারদের পকেটে। তবুও অভিযোগ না করে দিনশেষে আয়ের পুরো টাকা তুলে দেয় পরিবারের হাতে। এমন দৃশ্যই দেখা যায় বরগুনার আমতলী উপজেলার ইটভাটাগুলোতে। বেশিরভাগ ইটভাটায় শ্রমিক হিশেবে কাজ করছে আশপাশের গ্রামের শিশুরা। মৌসুমজুড়ে চলে শিশুশ্রমের মহাজজ্ঞ। কাঠ-কয়লা আর ধূলোবালিতে চাপা পরছে এসব শিশুদের রঙিন ভব্যিষৎ, আগুনে পুড়ছে শৈশব। আমতলী উপজেলা ১০ টি ইটভাটা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে ৯-১৫ বছরের শিশুরা। বেশ কয়েকটি ইটভাটা ঘুরে দেখা যায়, তীব্র শীত উপেক্ষা করে অতি ভোরে ভাটায় এসে কাজ শুরু করেছে শিশুরা। এদের কেউ কাঁচা ইট রোদে শুকাতে দিচ্ছে, ইট তৈরি করছে কেউ কেউ আবার ভ্যানে করে ইট টেনে চুল্লিতে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও মাটি বহন, ভাঙা ইট আলাদা করাসহ সব কাজেই নিয়োজিত আছে তারা।

উপজেলার চাওড়া ইউনিয়নের তালুকদার ব্রিকস, কুকুয়া ইউনিয়নের আনোয়ার হোসেন ব্রিকস, নুরজামাল ব্রিকস, মধু প্যাদার ভাটা ও সদর ইউনিয়নের সোবহান কাজীর ভাটাসহ বেশকয়েকটি ভাটায় শিশুশ্রম আইনের তোয়াক্কা না করোই এসব শিশুদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে। কর্মরত শিশুরা জানায়, কেউ এসেছে মা-বাবার সাথে, কেউ এসেছে অন্যের দেখাদেখি। পরিবারের অস্বচ্ছলতা ও বাড়তি আয়ের জন্যই এসব কাজ করছে তারা। এরা সবাই দৈনিক মজুরি হিসেবে কাজ করছে। তবে এমন ভারী কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় নানা দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয়। আহত বা অসুস্থ হলে তাদের নেই কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা, খোঁজ নেয় না ভাটা মালিকরা।

সোবাহান কাজীর ভাটায় কর্মরত শিশু কামরুল (৯) বলেন, মাদরাসায় কেবল ভর্তি হয়েছিলাম, এরই মধ্যে করোনা শুরু হয়। অনেকদিন ধরে মাদরাসা বন্ধ খালুর সাথে এই ভাটায় এসেছি। এখানে আমি কাঁচা ইট ভ্যানে করে চুলায় নিয়ে যায়। ১ হাজার ইট টানলে ১৬০ টাকা পাই। এখান থেকে ১০/২০ টাকা সর্দারকে দিতে হয়। বাড়ি মা আছে, বাবা অনেক আগেই অন্য যায়গায় বিয়ে করেছে। যেটাকা ইনকাম করি তা দিয়ে আমার আর মায়ের ভালোভাবেই চলে যায়। আনোয়ার ব্রিকসের আরেক শিশুশ্রমিক অলিউল্লাহ (১২) বলেন, বাবা গাছ থেকে পরে গিয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়েছিল। তাকে ডাক্তার দেখাতে অনেক ঋনে পরতে হয় আমাদের। মা বলেছে সকল ধার-দেনা পরিশোধ হলে আমাকে আর ভাটায় কাজ করতে হবেনা, আমি তখন আবার স্কুলে যাবো। এভাটায় আমি ইট শুকানোর কাজ করি। এসব ইটভাটার মালিকরা শ্রমিক সর্দারদের উপর দোষ চাপিয়ে বলেন, এসব বিষয়ে আমাদের কোন হস্তক্ষেপ নেই। শ্রমিকদের বিষয়টা সর্দাররা হ্যান্ডেল করে। তাছাড়া এসব গরীব শিশুরা কাজ করে কিছু টাকা ইনকাম করে। এখানে দোষের কিছুই দেখছিনা।

অবহেলিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা সামাজিক সংগঠন দুর্বার’র সভাপতি জালাল আহমেদ বলেন, এসব ইটভাটায় বছরের বড় একটা সময় জুড়ে চলে শিশু শ্রমের মহাযজ্ঞ। আগুনে প্রতিনিয়ত পুড়ছে হাজারও শিশুর ভবিষ্যৎ। ভাটার মালিকরা কম মজুরিতে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার লোভে শিশুদেরই ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে জড়াচ্ছেন। দীর্ঘ সময় কাজ করার ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, এজমা, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ আশা করছি আমরা। বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ভাটায় শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর কোন সুযোগই নেই। শিশুশ্রমে কঠোর আইন রয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে শিগগিরই ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হবে।

Recommended For You

Leave a Reply