শিক্ষক কে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষক তার শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলেন জাতির শেষ্ঠ সন্তান হিসাবে। কিন্তু সেই শিক্ষকই যদি দূর্নীতির সাথে জড়িত থাকে তাহলে তার কাছ থেকে জাতি ভালো কিছু পেতে পারেনা। দূর্নীতির সাথে জড়িত এমনই একজন শিক্ষকের খোঁজ পাওয়া মিলেছে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা সদর ইউনিয়নের পশ্চিম কুর্শা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল হাসনাত মুহাম্মদ জসীম। তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৯ পশ্চিম কুর্শা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র মেরামতের জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। তবে নামমাত্র কাজ করিয়ে বরাদ্দে টাকা অবৈধভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জসীম। এছাড়াও কার্য বিবরণী খাতায় কমিটির পাঁচ জন সদস্য উপস্থিত থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও শুধুমাত্র সভাপতির স্বাক্ষরে ২ লাখ টাকার তদারকি সভা সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। বাকি কোন সদস্যের স্বাক্ষর কোন স্বাক্ষর নেই।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের জন্য ২০১৮ সালে ৪ টি ফ্যান ৩ হাজার টাকা দরে ১২ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করার ভাউচার থাকলেও একজন শিক্ষক বলেন মাত্র ১৫০০ টাকা দরে ৪ টি ফ্যান মোট ৬ হাজার টাকায় ক্রয় করেন।আবার ২০১৯ সালে সেই চারটি ফ্যান ও আগের আরও চারটি ফ্যান মেরামত বাবদ ২ হাজার টাকা ধরে মোট ১৬ হাজার টাকার ভাউচার করেন। যা পরে সহকারী শিক্ষকগনের কাছে হাস্যরসের জন্ম দিয়েছিলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, বিদ্যালয়ের মাইনর মেরামতের জন্য বরাদ্দকৃত ২ লক্ষ টাকা মধ্যে প্রধান শিক্ষক সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকার কাজ করেন। বাকি প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা উনি আত্মসাৎ করেছেন।
২০২৩ সালে বিদ্যালয়ের ৫ টি স্টিলের আলমারি মেরামত বাবদ ৬ হাজার টাকায় ব্যয় করলেও ১২ হাজার টাকা ভাউচার করেন।
বিভিন্ন সময় বিদ্যালয়ে ছোট-বড় উন্নয়ন কাজের বিল রেজিস্টার খাতায় উল্লেখ করলেও বাস্তবে কোন কাজের হদিস পাওয়া যাইনি। ২০২৩ সালের মার্চে ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি প্রিন্টার ক্রয়েও দামে অসংগতি দেখা যায়। তখন প্রধান শিক্ষক আওয়ামীলীগের সক্রিয় কর্মী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করতে পারিনি।
প্রধান শিক্ষকের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ২০১৪ সালে হত্যার উদ্দেশ্যে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেন তারই নিজ এলাকার কিছু সাধারণ মানুষের উপর। যা পরে নিকলী থানায় ৩২৬ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলায় হাজিরা দিতে গেলে আবুল হাসনাত মুহাম্মদ জসীমের জামিন না মঞ্জুর করে কোর্ট তাকে নিয়ে জেলে প্রেরণ করেন।
বেশকিছু দিন হাজতে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেলেও একই মামলায় কোর্ট ২০১৮ সালে তাকে সাজা দিয়ে জেলে প্রেরণ করেন। তার এই ঘৃণ্য অপরাধের জন্য ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল দীর্ঘ ৪ বছর সাসপেন্ড করে রাখা হয়েছিলো।
২০২৪ সালের আগস্টেও তিনি অন্য একটি পক্ষকে হত্যার উদ্দেশ্যে দাড়ালো অস্ত্র দিয়ে গুরুতর আহত করেন। যা নিকলী থানায় দুসরা আগস্ট প্রধান শিক্ষক আবুল হাসনাত মুহাম্মদ জসীম কে প্রধান আসামি করে মামলা করেন। যার মামলা নং ১৭৫৫(৩)১ এবং ধারা ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬ সহ আরও বেশ কিছু গুরুতর ধারা। যা কোর্টে এখনো চলমান আছে। তার জীবন বৃত্তান্তে দেখা যায় তিনি বিভিন্ন গুরুতর জালিয়াতি, দূর্নীতি ও অপরাধ কর্মে জড়িত যা শিক্ষক চরিত্রের পরিপন্থি।
২০২১ সালে নিকলী উপজেলার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার সাকিল সাহেব কুর্শা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল হাসনাত মুহাম্মদ জসীমের বিরুদ্ধে জালিয়াতির প্রমাণ পেয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে অভিযোগ দাখিল করেছিলেন। কিন্তু দলীয় প্রভাব থাকায় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি প্রশাসন।
২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্টে সারা দেশে ম্যানেজিং কমিটি বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন নিকলী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরুল হাসান। প্রধান শিক্ষক এবং বিদ্যালয়ের সভাপতি একই দলের নেতা হওয়ার সুবাদে দুজনের মাঝে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠে। বিদ্যালয় কক্ষের দেওয়ালে আওয়ামী লীগের দলীয় বিভিন্ন পোস্টার সাজিয়ে রাখা হতো এমনকি বর্তমানেও বেশি কিছু পোস্টার অফিস কক্ষে সাজানো আছে।
বিদ্যালয়ের আরেক সহকারী শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, ইমরুল হাসান বিদ্যালয়ের সভাপতি হওয়ার পর থেকে প্রধান শিক্ষকের জালিয়াতি আরও বেড়ে গিয়েছিলো। প্রতিবছর মাইনর মেরামতের ও অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের বরাদ্দকৃত অর্থ সভাপতির যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক আত্মসাৎ করেছেন। এবং আওয়ামী প্রভাব থাকায় প্রধান শিক্ষক তার দায়িত্বে সবসময় স্বেচ্ছাচারী ভুমিকা পালন করেছেন।
পশ্চিম কুর্শা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবিভাবক ও এলাকাবাসীর দাবি, দূর্নীতিবাজ ও আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী প্রধান শিক্ষক আবুল হাসনাত মুহাম্মদ জসীমকে অপসারণ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং একজন সৎ, আদর্শ চরিত্রের অধিকারী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।